অঙ্গনওয়ারি কর্মী ছিলেন তিনি। দশ বছর আগে এক রাতের অন্ধকারে মাওবাদীরা ঘুম থেকে ডেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। মাওবাদীরা সেদিন তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর কাকা নন্দ বেসরাকেও। পরের দিন সকালে গ্রামের পথে মিলেছিল নন্দর রক্তাক্ত দেহ। কিন্তু সেই থেকে আর খোঁজ মেলেনি বান্দোয়ানের লেদাম গ্রামের বাসিন্দা অনিমা বেসরার।
কেটে গেছে এতগুলো বছর। এখনও মেয়ের সন্ধান পাননি বৃদ্ধা মা। মেয়ের ছবি, ভোটার কার্ড, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেটগুলো মাঝেমধ্যে বাক্স থেকে বের করেন অনিমার মা। সকলের অজান্তেই চোখের জল ফেলেন প্রত্যন্ত গ্রামের এই বৃদ্ধা। এতবছরেও দেহ পাওয়া যায়নি অনিমার। তাই মেলেনি কোনও সরকারি সাহায্য। হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা বলতে বলতে মা চূড়ামণি বেসরা বলেন, ”এতগুলো দিন গেল। কেউ মেয়ের খবর দিতে পারল না। যতদিন বাঁচব ততদিন এটুকু আশা নিয়ে থাকব হয়তো মেয়ে ফিরবে। আবার মা বলে ডাকবে।” দিনটা ছিল ২০১০ সালে ২২ শে অগস্ট। মাওবাদীদের হত্যালীলায় সে সময় মানুষের ঘুম ছুটেছে প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে। কবে কার বাড়িতে হানা দেবে তারা, আতঙ্কের প্রহর গুনত জঙ্গলমহল। শুধু ধনী জোতদার নয়, সিপিআই(এম) ঘনিষ্ঠ হলেই গরিব, দরিদ্র, প্রান্তিক সীমায় বসবাসকারী মানুষদেও নির্বিবাদে খুন করত তারা। জঙ্গলমহল বান্দোয়ান এর কুমড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রাম লেদাম। শাল জঙ্গলের মাঝখানে ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের সীমা পেরোলেই বাঁশপাহাড়ি, বেলপাহাড়ি। ঘটনার দিন সময়টা ছিল সন্ধ্যা সাতটা। জঙ্গলমহলে তখন গভীর রাত। দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতর শুয়ে পড়েছিলেন সবাই। চূড়ামণির স্মৃতিতে সেই রাত এখনও দগদগে ক্ষত। বাড়িতে বেশ কিছু মানুষ এসে দরজা ধাক্কা দিয়েছিল। আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিলেন তাঁরা। অজানা আশঙ্কায় দরজা খুলতে চাইছিলেন না। বাড়ির ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন বাইরে কারা? উত্তর এসেছিল, ”আমরা বন পার্টি।” ভয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিয়েছিলেন বাড়ির লোকজন। ভিতরে ঢুকেই প্রথমে অনিমার খোঁজ করেছিল রাতের অন্ধকার পেরিয়ে আসা অচেনা মানুষগুলো। তারপর ভেতরের ঘর থেকে অনিমাকে তুলে নিয়ে এসে হাত দুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলেছিল। খোঁজ করেছিল অনিমার কাকা নন্দ বেসরার। তাকেও ঘর থেকে বার করে হাত দুটো পেছনে বেঁধে দুজনকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল তারা। পরদিন সকালে গ্রামের এক প্রান্তে নন্দ বেসরার রক্তাক্ত মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছিল পরিবারের লোকজন। কিন্তু অনিমার খোঁজ পাওয়া যায়নি আর। চূড়ামণি বেসরা জানান, পাশের গ্ৰাম রাজাউলিতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী ছিলেন তাঁর মেয়ে। মেয়ের রোজগারেই সংসার চলত। থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলেন। সাধ্যমতো বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু কোনও দিক থেকে কোনও ভাবেই সন্ধান পাওয়া যায়নি অনিমা বেসরার। সিপিআই(এম)জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য রথু সিং জানিয়েছেন, পরিবারটির অপরাধ ছিল তারা সিপিআই(এম) সমর্থক। অনিমা আইসিডিএস ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় বান্দোয়ান এলাকায় যে সমস্ত মানুষদের মাওবাদীরা খুন করেছিল তারা দারিদ্র্যসীমার একেবারে নীচে বসবাসকারী। ২০১৩ সালে অনিমার বাবা গুরুদাস বেসরা বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। অনিমার ভাই জগন্নাথ বেসরা দিনমজুরি করেন। সেই আয়ই ভরসা পরিবারের। দিদির কথা বলতে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ভাই জগন্নাথের। তিনি জানান, তাঁর দিদি যখন নিখোঁজ হয়েছিল তখন বয়স ছিল ৪৬ বছর। পনেরশো টাকা বেতন পেতেন দিদি। সেই টাকা দিয়ে সংসার চলত তাঁদের। এখন দিনমজুরির সামান্য ক’টা টাকায় কোনওমতে না মরে বেঁচে আছেন। এতদিন পরে মাওবাদী হামলার শিকার হয়ে দশ বছরেরও বেশি যাঁরা নিখোঁজ, তাঁদের পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা শোনার পর থেকেই ভুলে থাকা মেয়ের শোক ফের গ্রাস করেছে গোটা পরিবারকে। কী করলে সরকারি চাকরি মিলবে তা খুব একটা স্পষ্ট নয় জগন্নাথ বেসরা আর তাঁর মা চূড়ামণির কাছে। তাহলে কি মেয়েকে মৃত বলেই ধরে নিতে হবে এবার? এই প্রশ্নই ঘুরছে মনে। কারণ এতগুলো বছর তো প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ একদিনের জন্যেও তাদের খোঁজ নেয়নি। ভাঙা চালার নীচে দাঁড়িয়ে চূড়ামনি তাই বলে যান, ”সবচেয়ে খুশি হব মেয়েটা যদি ফিরে আসে। সে কি আর হবে না?